• [english_date] , [bangla_date] , [hijri_date]

শেকড় থেকে শিখরে: বর্ণে ছন্দে জাহাঙ্গীর কবির নানক

Sonaly Sylhet
প্রকাশিত January 16, 2024
শেকড় থেকে শিখরে: বর্ণে ছন্দে জাহাঙ্গীর কবির নানক

যিনি মানুষকে দক্ষতার সাথে সংগঠিত করতে পারেন, অনুপ্রাণিত করতে পারেন, তিনিই তো দক্ষ সংগঠক, যোগ্য নেতা। এরকম দু একজন ছাত্রনেতা জন্মেছেন বরিশালে। যারা ছিলেন ছাত্রপ্রিয়, জনপ্রিয়। এদের একজন জাহাঙ্গীর কবির নানক অন্যজন শহীদুল ইসলাম খান (শহীদ খান)। শহীদ ভাই অকালে প্রয়াত হয়েছেন। অন্যজন তারই গুরু জাহাঙ্গীর কবির নানক। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক কর্মবীর নানক ছাত্রজীবন থেকেই মেধার পরিচয় দিয়ে আসছেন। তিনি একজন সুবক্তা,দক্ষ সংগঠক ও কর্মীবান্ধব নেতা। কর্ম আর মেধায় সমন্বয়ে তিনি ছাত্রনেতা থেকে আজ জননেতায় পরিণত হয়েছেন। আজও ছুটে বেড়ান ‘অরুণ প্রাতের তরুণ দলের’ মত। বরিশাল থেকে সিলেটে। সিলেট থেকে ঢাকায় বিজয় রথের সারথী হয়ে।

সনটা মনে নেই। বিএম কলেজে গেলাম। অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে এক বন্ধু পরিচয় করে দিলেন নানক ভাইয়ের সাথে। অফিস থেকে পূর্বদিকে এগিয়ে। হেঁটে যাচ্ছিলেন অডিটোরিয়ামের দিকে। গায়ে সফেদ পাঞ্জাবি। মোটা গোঁফের ফাঁকে হাসির ঝিলিক। হাত বাড়িয়ে দিলেন। হাত মেলালাম। মনটা আনন্দে ভরে গেল। শিখ ধর্ম গুরু নানকের মতই দীক্ষা দিতেন তিনি। গঠনমূলক, সুস্থ রাজনীতি শেখাতেন ছাত্রদের। আমিও একসময় তারই মন্ত্রে দীক্ষিত হলাম। শিখলাম বাধা দিলে বাধবে লড়াই সে লড়াইয়ে জিততে হবে, লড়াইয়ে জিতবে কারা, বঙ্গবন্ধুর সৈনিকেরা। জাহাঙ্গীর কবির নানক। আমাদের নানক ভাই। বর্ণে বর্ণে বর্ণময় আর ছন্দে ছন্দে ছন্দময় যার রাজনৈতিক  জীবন। জন্ম ১৪ জানুয়ারি ১৯৫৪, পৈতৃক বাড়ি বরিশাল শহরের ক্ষীরোদ মুখার্জী লেনে । জন্মেই দেখেন ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি। শোনেন ‘রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলোনো করিলি রে বাঙ্গালী তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি’।

ভয়ঙ্কর অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মধ্যেই ভর্তি হলেন শহরের একে স্কুলে। স্কুলে পড়া অবস্থাতেই রাজনীতিতে হাতে খড়ি। সালটা ১৯৬৭। তখন ‘নয়া ইতিহাস লিখছে ধর্মঘট; রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদপট’।পাকিস্তানী শাসন শোষণের বিরুদ্ধে তখন ক্ষুদ্ধ স্বদেশ। বিদ্রোহ শুধু বিদ্রোহ চারিদিকে। স্কুল জীবন শেষ করেন মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান দিতে দিতে। ১৯৬৯-৭০ সালে এস এস সি পাস করে ভর্তি হলেন জ্ঞানের আলো ছড়ানো  বিদ্যাপীঠ বিএম কলেজে।তখন পাকিস্তানি শৃংখল থেকে মুক্তির দাবীতে উত্তাল বাংলাদেশ। ২৫ মার্চের কালো রাতে ঢাকায় নিরীহ বাঙালি উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পরিস্থিতি অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাতেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। বরিশালে এই ঘোষণা পৌছালো তার বার্তায়। সারা দেশের মতো উৎকণ্ঠায় ছিল বরিশালবাসীও। ঢাকায় কি হচ্ছে? কি হবে? হঠাৎ মাইকের শোনা গেল জাহাঙ্গীর কবির নানকের ভরাট কন্ঠ শোনা গেল, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। মুক্তির যুদ্ধের জন্য সবাইকে প্রস্তুত হতে বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর তার বার্তা পাওয়ার সাথে সাথেই নানক ভাই এক সংগীসহ বেড়িয়ে পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের জন্য। প্রচার করলেন বঙ্গবন্ধুর সেই অমর ঘোষণা। গর্জে উঠলো বরিশালবাসী। প্রস্তুতি নিল মুক্তিযুদ্ধের।

শুরু হল পরাধীনতার শৃংখল ভাংগার যুদ্ধ। জাহাঙ্গীর কবির নানকও যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বিজয় এলো। বিজয়ের গান গাইতে গাইতে ফিরে এলেন ক্যাম্পাসে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন তরুন ছাত্রনেতা হিসেবে। মশাল জ্বালালেন তারুন্যের দ্রোহে। ক্যাম্পাসে এলো জাগরণ। ১৯৭৪ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে বিএম কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন। তিনি জিএস পদপ্রার্থী। ভিপি প্রার্থী মনসুর আলম মন্টু। কিন্তু তৎকালীন সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় নির্বাচন বন্ধ হয়ে গেল। ‘৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট। রক্তের রঙ ভোরের আকাশে। পৃথিবীও বিশাল পাখায় গাঢ় রক্ত মেখে ভাসছে বাতাসে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু নিষ্ঠুর বুলেটের আঘাতে নিহত হলেন। স্বদেশের মানচিত্র জুড়ে পড়ে আছে রক্তাক্ত লাশ। মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে ঘরে ফিরলেও এবার আর ঘরে ফেরা হলো না নানক ভাইয়ের। বিদ্রোহী হয়ে উঠলো কীর্তনখোলা পাড়ের কয়েকজন তরুন-জোয়ান। জাতির জনকের রক্ত, সেই লাল টকটকে রক্ত ৩২ নম্বরের সিড়ি বেয়ে বাংলার দূর্বা ছোঁয়ার আগেই সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্রদের সংগঠিত করতে লাগলেন তিনি। ‘৭৫ এর ৩০ আগস্ট মোশতাক সরকার সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করল। কিন্তু থামলেন না এই বিদ্রোহী তরুন নেতা। গোপনে কাজ করতে লাগলেন শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে, নতুন নিশান উডিয়ে, দামামা বাজিয়ে দিকবিদিক’। শোকাহত মানুষকে শোনালেন, “আয়,আয় ছুটে আয়, সজাগ জনতা আয় আয় নিয়ে আয়, নতুন বারতা রামের দেশেতে সেই রাবণ বধিতে যায় যদি যায়, জীবনটা যাক।

১৯৭৬ সাল। জাহাঙ্গীর কবির নানক ও শহীদুল ইসলাম খানসহ তৎকালীন কয়েকজন ছাত্রনেতা সিদ্ধান্ত নিলেন ১৫ই আগস্ট বরিশালে হরতালের ডাক দিবেন। যেবার বরিশালে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দিতে কেউ সাহস পায়নি। সড়কে আঁকা হয়নি আলপনা, দেয়ালে বর্ণমালা। আগস্টের ১০ তারিখ। শবে বরাতের দিন। সূর্য তখনও অস্ত যায়নি। সৃষ্টিকর্তা হয়তো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের ভাগ্য লেখা শুরু করবেন। ১৫ আগষ্ট হরতালের সমর্থনে বিএম কলেজে গোপন সভা চলছে। কিন্ত সামরিক জান্তারা গোপনে খবর পেয়ে সভাস্থল ঘিরে ফেলল। সেখান থেকে গ্রেফতার করলেন জাহাঙ্গীর কবির নানককে। তারপর দিনের পর দিন চলল অমানুষিক নির্যাতন। সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হলো তাকে। সে দিনের দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে আজও শিউরে ওঠেন তিনি। বললেন, ‘দীর্ঘ ১৪ মাস ডিটেনশনে থাকতে হয়েছে। ডিটেনশনে নির্ধারিত মেয়াদ থাকে এক মাস, দুমাস, তিন মাস কিন্তু আমার ডিটেনশন ছিল পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত। জেলে বসেই অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিতে হয়েছিল’। ‘জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’। জেল থেকে বের হয়ে ছাত্র-জনতাকে আবার সংগঠিত করতে থাকেন।বরিশালে তৈরী হয় এক ঝাঁক ত্যাগী ছাত্র নেতা আর এক দল প্রতিবাদী কর্মী। ‘৭৫ পরবর্তী রাজনীতিতে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতে শামসুদ্দিন খাজা, এনায়েত হোসেন হাওলাদার, সুভাষ রায, হাবিবুর রহমান শাহজাহান, হেমায়েত উদ্দিন হাওলাদার, শহীদ খানের ত্যাগের কথা তিনি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। মনে পড়ে ১৪ আগষ্ট সকালে নানক ভাই, শহীদ ভাই চৈতন্য স্কুলের একটি নির্জন কক্ষে বসে গোপনে ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবসের পোস্টার বিতরণ করতেন ছাত্রদের মাঝে। রাতে পোষ্টার গুলো গাম দিয়ে লাগানো হত প্রধান প্রধান সড়কের পাশের ভবনে-দেয়ালে।

তখন সদ্য স্বাধীন স্বদেশকে সামরিক শাসনের শৃংখল থেকে মুক্ত করতে স্বাধীনতার স্বপক্ষের রাজনৈতিক দলের নেতাদের উপর চলে নানারকম নির্যাতন-নিপীড়ন। ১৯৭৭ সালে দেশে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে অশ্বিনী কুমার হলে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশে তৎকালীন সরকারি মদতপুষ্ট সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন তিনি। সন্ত্রাসীদের লাঠির আঘাতে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। একই বছর ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মালেক  উকিল ও আব্দুর রাজ্জাকের উপর সন্ত্রাসীদের হামলার প্রতিবাদে শহরে একটি বিক্ষোভ মিছিল চলাকালে লাইন রোডের মুখে আর্ট ভিলা ষ্টুডিওর সামনে তৎকালীন সরকার দলীয় সন্ত্রাসীরা তাকে ডেগার দিয়ে আঘাত করে কিন্তু অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৭৯ সালে বিএম কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের নানক-শহীদ পরিষদে তিনি ছিলেন ভিপি প্রার্থী। কিন্তু সেবারও নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায় সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায়। তৎকালীন ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘আমরা বিএম কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষনার দাবীতে স্বাধীনতার পর থেকে আন্দোলন করেছি। দাবীর স্বপক্ষে ১৯৭৪ সালে আমরা তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সভামঞ্চ ভেঙে দিয়েছি। আমরা তাকে বরিশালের জনসভা করতে দেইনি। ভাবা যায়! ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে ছাত্র নেতারাইতো তো কথা বলবে। শ্লোগান দেবে ছাত্র বেতন কমাতে হবে, কাগজ-কলম বইয়ের দাম কমাতে হবে কমাতে হবে। স্বাধীন দেশে এটাই তো ছাত্র আন্দোলন আর যার নেতৃত্বে আন্দোলন তিনিই তো যোগ্য ছাত্রনেতা। সে মানের নেতাই তো জাহাঙ্গীর কবির নানক। ১৯৮১ সালে আবার বিএম কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন। জিতল ছাত্রলীগের পূর্ণ প্যানেল। নানক ভাই ভিপি আর শহীদ ভাই জিএস নির্বাচিত হলেন। তাদের দক্ষতায়ই বরিশাল কলেজে জিতল জাহাঙ্গীর-আফজাল পরিষদ। নানক ভাই, শহীদ ভাইয়ের বক্তৃতা ছাত্র সমাজকে অনুপ্রাণিত করল। মনে পড়ে, নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত নানক ভাই পূর্বদিকের রাস্তায় হেঁটেছেন এমাথা থেকে ওমাথা। তখন বরিশাল কলেজের প্রধান গেট ছিল পূর্বদিকে। এরকম কত শত বিজয় দেখেছি নানক ভাইয়ের নেতৃত্বে। যোগ্যতার পুরস্কার স্বরূপ ’৮৪ সালে হলেন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক। সংগঠিত করলেন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ছাত্রসমাজকে। আগুনের পরশমণি ছোঁয়ালেন ছাত্র সমাজের প্রাণে প্রাণে। দহন দানে পূর্ণ হোল ছাত্রলীগ। ভর্তি হলেন শ্লোগান-কবিতা আর সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ডাকসুতে নির্বাচন করলেন কাদের-নানক পরিষদে। জিএস পদে। তিনি ২০০৩ সালে আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন যুগ্ম সম্পাদক থেকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও কিছুদিন পর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন জাহাঙ্গীর কবির নানক। সর্বশেষ কাউন্সিলে তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০০৯ ও ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে কজন হাতে গোনা নেতা শেকড় থেকে শিখরে উঠেছেন তাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর কবির নানক অন্যতম। তিনিই আমাদের প্রিয় নানক ভাই। তারই নেতৃত্বে এবার বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজয় হলো সেদিন। বরিশালের নতুন মেয়র হলেন আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। ছুটে গেলেন সিলেটে। বিজয় এল। বরিশাল এলেন, সিলেট গেলেন, দেখলেন জয় করলেন। অবিস্মরণীয় এক জয়ে উল্লসিত সারা দেশ, মেতে উঠলো বিজয় উল্লাসে। আজ তিনি দেশের সংকটে আওয়ামী লীগের নির্ভরতার ঠিকানা। সংকটে, সংগ্রাম্ স্বপ্নে, সাহসে সহযাত্রী। বর্তমান ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে তিনি বলেন ‘বর্তমানে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কাঠামো শুরু হয় ওয়ার্ড থেকে আর আমাদের সময় হত স্কুল থেকে। শিশু-কিশোররা স্কুল থেকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে কলেজে ভর্তি হত। তৈরী হত যোগ্য নেতৃত্ব। তিনি আরও বলেন দেশে ত্যাগের রাজনীতির সীমাহীন সংকট। ‘৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পর সামরিক জান্তারা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা ৮৫ বছরের বৃদ্ধ দেবেন্দ্র নাথ ঘোষকেও গ্রেফতার করেছিল। আমি জেলে গিয়ে তাকে দেখেছি।’ সংকটে তিনি আমাদের সাহস জুগিয়েছেন। ত্যাগী রাজনীতিবিদ ছিলেন বলেই সামরিক জান্তারা তাকে ভয় পেয়েছিল। তিনি সর্বস্ব ত্যাগী এই রাজনৈতিক নেতাকে আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। প্রবীন বিপ্লবী, আওয়ামী লীগ নেতা দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ সদর রোডের আর্ট ভিলা স্টুডিওর দোতালায় বসতেন। সেখানে বহু দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা আসতেন। এ প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী চন্দন ঘোষ ছিলেন সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের নেপথ্যের সাথী।

পঁচাত্তর পরবর্তী বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক সামসুদ্দিন খাজা সুদূর লন্ডন থেকে মুঠোফোনে বলেন, জাহাঙ্গীর কবির নানক  মেধাবী ও সাহসী সংগঠক। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড গোটা জাতিকে হতভম্ব ও গভীর হতাশায় নিমজ্জিত করে। ‘৭৭ সালে জাহাঙ্গীর কবির নানক জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও আমি সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হই। জাহাঙ্গীর কবির নানকের যোগ্য নেতৃত্বে আমরা বরিশালে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করি এবং ঐ বছর ১৫ আগস্ট শহরে ঝটিকা মিছিল বের করি। তিনি সুদূর প্রবাসে থেকেও আবেগ আপ্লুত কন্ঠে বলেন, দুঃসময়ের সাথী দীপক দাস, মাহাবুব, নিয়াজের , শাহজাহানের কথা খুব মনে পরে। তিনি বলেন, দুঃসময়ে কর্মীদের মাঠে রেখে নানকভাই কখনও পালিয়ে যাননি। ‘৭৬ সালের ১৫ আগস্ট হরতালের সমর্থনে বিএম কলেজে সভা চলাকালে পুলিশ আমাদের ঘিরে ফেলে কিন্তু নানক ভাই নিজে গ্রেফতার হয়ে কর্মীদের নিরাপদ স্থানে সরে যাবার নির্দেশ দেন। তিনি সঙ্কটের কল্পনাতে কখনও ম্রিয়মাণ হননি। তিনি ভয় মুক্ত হয়ে আপনা-মাঝে শক্তি ধরে, নিজেরে করো জয় করতে জানেন। সামসুদ্দিন খাজা ৭৫ পরবর্তী সঙ্কট কালীন সময়ে নেপথ্যের কারিগর আর্ট ভিলার ষ্টুডিওর মালিক চন্দন ঘোষের অবদানের কথাও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, চন্দন ঘোষ তার দোকানের পেছনে আমাদের গোপন সভা করার ব্যবস্থা করতেন। অর্থ সহায়তা করতেন দু’হাত ভরে। প্রবাসী চন্দন ঘোষও নানক ভাইয়ের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রসংসা করে বলেন, সেই সঙ্কট কালে আমার দোকানের পাশের মন্দিরে বারান্দায় তারা সভা করতেন।আমি সামনে পাহারায় দাঁড়িয়ে থাকতাম।পুলিশের উপস্থিতি টের পেলে তাদের ধর্মরক্ষিনীর পাশ দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার ব্যবস্থা করতাম। নানক ভাই জেলে থাকা কালে আমি খাবার নিয়ে তার সাথে দেখা করতে যেতাম। তখন ভুলু ভাই, দেবেন দাদুও বরিশাল জেলে বন্দী ছিলেন।

নিরহঙ্কারী, সাদামাটা মানুষ সরদার নিয়াজুল মুস্তফা। সেই সময় ছিলেন শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আর সভাপতি ছিলেন সুভাষ রায়। নানক ভাইয়ের নেতৃত্ব প্রসঙ্গে নিয়াজুল মোস্তফা বলেন ‘৭৭ সালের নানক ভাই আমাদের নির্দেশ দিলেন ১৫ আগষ্ট বিকেলে আমরা ভ্রাম্যমান ট্রাক মিছিল বের করব। ঐদিন অশ্বিনী কুমার হলে সামরিক সরকার নাজাত দিবস পালন করবে। আমরা কৌশলে ঐ প্রোগ্রাম ভন্ডুল করে দেব। কাজ করতে হবে ঝটিকা বেগে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৪ আগষ্ট রাতে আমরা সদর রোডে জেড আই খান পান্না ভাইয়ের বাসায়, তার ছোট ভাই বাবুর সহায়তায় একটি ছোট্ট টেপ রেকর্ডারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, কিছু মুক্তিযুদ্ধের গান আর নানক ভাইয়ের ভরাট কন্ঠে ১৫ আগষ্টের মর্মান্তিক ঘটনার ধারা বর্ণনা রেকর্ড করি। ১৫ আগস্ট দুপুরের পর ট্রাকে মাইক বেঁধে আমরা ল’ কলেজের সামনে, নতুন বাজার, নথুল্লাবাদ, সাগরদী মোড়, মেডিকেল কলেজের গেটে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজাই। মানুষ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে পাগলের মত দৌড়ে আসে ট্রাকের সামনে। সে দিন মনে হল আমরা বিজয় দেখছি। সর্বশেষে স্টীমার ঘাটের কর্মসূচী শেষ করে ত্বরিত গতিতে ট্রাক নিয়ে যাই অশ্বিনী কুমার হলের সামনে। ভেতরে তখন সরকারী অনুষ্ঠান চলছে। সামরিক জান্তারা নাজাত দিবস পালন করছে। তখন বক্তৃতা করছিলেন তৎকালীন  সামরিক সরকারের উপদেষ্টা এনায়েতুল্লাহ খান। আমরা অশ্বিনী কুমার হলের সামনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ  বাজানো শুরু করলেই মানুষ হলের ভেতর থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে. ছুটে আসে ট্রাকের সামনে। আমরা বুঝতে পারি সরকারি সভা পন্ড হয়েছে। কাজ শেষ আমরা দ্রুততার সাথে সরে পড়ি। এভাবেই নানক ভাই আমাদের সাহসী সিদ্ধান্ত দিতেন আর আমরা তা পালন করতাম। ‘৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পর সেবারই বরিশালে প্রথম বঙ্গবন্ধুর ভাষন প্রকাশ্যে প্রচার হয়। নানক ভাই ‘৭৫ পরবর্তী বরিশালের আওয়ামী রাজনীতি পুনর্গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এই হচ্ছেন আমাদের নানক ভাই। আমাদের নানক ভাই। সেই দুর্দিনে এই কর্মসূচী সফল করতে মাইক দিয়েছিলেন রাজ্জাক ভাই আর ট্রাক দিয়েছিলেন লাইন রোডের নুপুর হোটেলের মালিক। অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ তপংকর চক্রবর্তী নানক ভাই সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, তার অনুপ্রেরণায়ই আমি ‘৭৯ সালে ব্রজমোহন কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ থেকে সাহিত্য সম্পাদক পদে প্রাথী হই। তিনি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সংগঠক।

নানক ভাই! লিখতে লিখতে মনে পড়ছে পিছনের কথা, অনেক পিছনের কথা। একটি ঘটনা খুব বেশী মনে পড়ছে। সনটা মনে নেই। তবে ৭৫ সালের অনেক পরে। বিএম স্কুলে পড়ি। কাউনিয়া প্রধান সড়ক থেকে আমি মতি (অকাল প্রয়াতঃ) আর রঞ্জু (দি মেডিকাস) চৈতন্য স্কুলে গেলাম ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবসের পোষ্টার আনতে। নানক ভাই ও শহীদ ভাই ৫/৬ খানা পোষ্টার  দিলেন। দেশে তখন সামরিক শাসন। বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়া যাবে না। পোষ্টারগুলো লুকিয়ে আনতে হবে ।আমার পড়নে হাফ প্যান্ট আর শার্ট। তাই পোষ্টারগুলো পেঁচিয়ে সরু করে শার্ট ও প্যান্টের ভেতর অর্ধেক অর্ধেক ঢুকিয়ে নিলাম। তিনজন বিএম স্কুলের পেছন দিয়ে হেঁটে এলাকার দিকে যাচ্ছি। নার্সিং কলেজের সামনে আসতেই সরকারী দলের এক পরিচিত বড় ভাই আমার হাঁটুর দিকে তাকিয়ে বলল, ওটা কি? চেয়ে দেখি পোষ্টারগুলো হাঁটার তালে ঘর্ষণে ঘর্ষণে হাফ প্যান্টের ভেতর দিয়ে হাঁটু পর্যন্ত নেমে গেছে। তাড়াতাড়ি ওগুলো টেনে শার্টের উপরের দিকে উঠিয়ে নিলাম। এ ঘটনা মনে পড়লে আজও হাসি পায়। রঞ্জুর সাথে মাঝে মাঝে সেই স্মৃতিচারণ করি। স্কুল জীবন থেকে কত ছাত্রনেতাকে দেখেছি। আনোয়ার ভাই, দেলোয়ার ভাই, নিয়াজ ভাই, শাহজাহান ভা্ই, সুভাষ দা, হেমায়েত ভাইকে। খুব বেশি মনে পড়ছে শহীদ ভাই আর তার জোড়া শব্দের সমার্থক নানক ভাইকে। কত মিছিল! কত শ্লোগান!! ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে যাই। মন ছুটে যায় বিএম কলেজ ক্যাম্পাসে। শহীদ মিনার, অফিস বিল্ডিং, নারকেল বাগান, ডিগ্রি বিল্ডিং, হোস্টেল ছুঁয়ে থামে উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাশের গ্যালারিতে। সব জায়গায়ই তোমার স্মৃতি বহমান। মনে হয়, আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব সারা রাত ফোটায় তারা নব নব।

নানক ভাই! ঐ শুনুন শ্লোগান। মিছিল আসছে। বিশাল মিছিল। নেতৃত্বে সেকালের ছাত্রনেতারা। সামনেই বিএম কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন। শহীদ ভাই জিএস, জাহাঙ্গীর ভাই এজিএস প্রার্থী। ‘দেখো আকাশ তারায় ভরা। দেখো যাওয়ার পথের পাশে ছোটে হাওয়া পাগলপারা। এত আনন্দ আয়োজন, সবই বৃথা তোমায় ছাড়া’। আপনি দাঁড়াবেন ভিপি পদে? আমরা আবার শ্লোগান দেব নানক-শহীদ পরিষদ সবার সেরা পরিষদ। এবারের আন্দোলন সুস্থধারার ছাত্ররাজনীতির জন্য, এবারের আকুলতা ত্যাগী মেধাবী ছাত্রনেতা থেকে রাষ্ট্রনেতা তৈরির জন্য, এবারের স্বপ্ন অসাম্প্রদায়িক, শোষনহীন, স্মার্ট সোনার বাংলার জন্য। ‘তোমার আসন শূন্য আজি, হে বীর পূর্ণ করো। এই প্রভাতে দখিন হাতে বিজয়খড়্গ ধরো’। জয় আমাদের অনিবার্য।