সুনামগঞ্জের পাহাড়ী নদী যাদুকাটার ইজারা বাতিলের দাবি জানালেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা)’র নির্বাহী প্রধান আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সোমবার দুপুরে সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউস মিলনায়তনে হাওরের বাঁধ, কৃষি নদী ও পরিবেশ সংকট নিরসনে করণীয় শীর্ষক সভায় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী প্রধান আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এই দাবি জানান।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সভায় বক্তব্য রাখার সময় প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে করে বলেন, আপনাদের আর কীভাবে বললে, আপনারা জাদুটাকা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে পারবেন। আপনারা কী পারেন না এক বছরের জন্য জাদুটাকার লিজ বাতিল করে দিতে। দয়া করে কর্মসংস্থানের দোহাই দেখাবেন না। বালু উত্তোলনের ফলে মৎস্যজীবীরা ওখানে গিয়ে মাছ ধরতে পারে না। বালু উত্তোলনকারীদের চেয়ে মৎস্যজীবীদের সংখ্যা বেশী। আর মাছের ভোক্তার পরিমাণ বালু উত্তোলনকারীদের চাইতে অনেক বেশী। আপনারা কী কোন দিনও আইন ভঙ্গকারীদের শাস্তি দেবেন না। ফিতা নিয়ে শুধু জায়গা মেপে আসলে হবে না, আপনারা তো জানেন, ফিতার মাপ ওরা (ইজারাদাররা) পাল্টে দেয়। সেক্ষেত্রে শাস্তি দিতে বাধা কোথায়।
তিনি জানান, সিলেটে একই ধরণের বালু—পাথর মহাল জাফলং নিয়ে অনেক সফলতা পাওয়া গেছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে ইন্টারফেয়ার করে বলা হয়েছে, ‘এখানে বালু উত্তোলন করা যাবে না। কারণ পর্যটন থেকে এর চেয়ে বেশি আয় হবে। বালু—পাথর উত্তোলনের টাকা কয়েকজনের পকেটে যায়, আর পর্যটনের টাকা জাতির ট্রেজারিতে আসে। জাদুকাটা পর্যকদের প্রিয় স্থান। এটাকে কয়েকজন ব্যবসায়ীর স্বার্থে আমরা ব্যবহৃত হতে দেব কেন? তিনি প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন রাখেন, ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বড়, না সকলের স্বার্থ বড়, না নদীর স্বার্থ বড়। নদীকে জীবন্তসত্তা মানতে হলে আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেন, বাঁধ নির্মাণে পাব্লিক কনসালটেশন হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার সরকার যাদের পাব্লিক বলছে, তারা হয়তো বাঁধের উপকারভোগি পাব্লিক নন।
তিনি বলেন, হাওরে মাছের উৎপাদনে যদি আমরা মনযোগ না দেই, তাহলে কোন এলাকার মাছের ব্যাপারে মনযোগ দেবো। আপনি আপনার আগামী প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাবেন, এটা অনেক বড় প্রশ্ন। প্রশাসনকে এর উত্তর দিতে হবে। যখন আপনারা জলাশয়গুলো লিজ দেন তখন কাগজে লিখে রাখেন এই এই কাজ করা যাবে না। সম্পূর্ণ শুকিয়ে ফেলা যাবে না, হিজল করচ গাছ কাটা যাবে না এগুলো কিন্তু লেখা থাকে। কিন্তু যখন এটা প্রতিপালন না হয়, তখন আপনারা কেন লিজটা বাতিল করেন না। যারা লিজ পায় তারা এমন ভাবে মাছ ধরেন, সেখানে মৎস্যজীবীদের এক্সেসের কোন বিষয় থাকে না।
বিষ দিয়ে পাখি মারার ব্যাপারে জনসচেতনতা ও আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পর্যটকদের প্রতিপালনের জন্য টাঙ্গুয়ার হাওরে ১০টি নিয়ম আছে, সেগুলো পালন হচ্ছে না। একই নিয়ম সকল হাওরের জন্য করা যায় কী—না এবং এগুলো পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীনে বিধিমালা হিসেবে করে প্রয়োজনে ওখানে পর্যটকদের রাতে থাকা বন্ধ করে দিতে হবে। হাউস বোটের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করেন। পর্যটকদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করেন, অনলাইনে নিবন্ধন চালু করার মাধ্যমে এগুলো করা সম্ভব। হাওরের মাস্টারপ্ল্যান আমরা সময়োপযোগি করার দাবি তুলতে পারি। পরিবেশ ও বন অধিদপ্তরের নানা বিষয় উল্লেখ করে দায়িত্বে গাফিলতার কথা তুলে ধরেন তিনি।
তিনি বলেন, পদ্মা, মেঘনা, সুরমা, যমুনা যদি হারিয়ে যায় তাহলে মানুষ হিসেবে আমরা যত না ব্যর্থ হবো, প্রশাসক হিসেবেও আপনাদের আমরা সুবিধাজনক অবস্থায় দাঁড় করাতে পারছি না।
বেলা, এএলআরডি ও পানি অধিকার ফোরামের যৌথ আয়োজনে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, জলাশয় লিজ দেওয়ার সময় শর্ত থাকে গ্রহিতা কী করতে পারবেন, আর কী পারবেন না। শর্ত না মানলে লিজ বাতিল করার ক্ষমতা ও প্রচলিত আইনে মুভমেন্ট করার ক্ষমতা রয়েছে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমাদের এই কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা একটা কমন অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রে আমরা এর সত্যতা পেয়েছি, জেল, জরিমানাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বালু মহাল বা জলমহালের লিজ কয়েক বছর বন্ধ রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, আইনগত কোন সুযোগ আমি দেখেছি না। এটা আসলে পলিসি লেভেলের সিদ্ধান্ত, আমি চেষ্টা করবো এটা নিয়ে বৃহত্তর ফোরামে বা যারা এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, তাদের দৃির্ষ্ট আকর্ষণ করার।
সভায় বিশেষ অতিথি’র বক্তব্য রাখেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু সাঈদ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাওর ও কৃষি তথ্য বিভাগের প্রধান নজরুল ইসলাম। প্যানেল আলোচন ছিলেন, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সৈয়দ মুহিবুল ইসলাম, হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায়, সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ—বিভাগীয় প্রকৌশলী শমশের আলী প্রমুখ। এছাড়া উপস্থিত অংশগ্রহণ কারীদের মধ্যে, শাহানা আল আজাদ, মিজানুর রহমান, কামরুজ্জামান, সেলিনা বেগম, তোজাম্মুল হক, আবুল হোসেন, সাংবাদিক হিমাদ্রি শেখর ভদ্র, বিন্দু তালুকদার, শাহ্ আখতারুজ্জামান, শহীদ নূর প্রমুখ বক্তব্য দেন।