এফআর টাওয়ারের ভবনের নকশাতেই অগ্নি নিরাপত্তা বিবেচনা করা হয়নি: আইইবি

প্রকাশিত: ৮:৪৩ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ৭, ২০১৯

এফআর টাওয়ারের ভবনের নকশাতেই অগ্নি নিরাপত্তা বিবেচনা করা হয়নি: আইইবি

সোনালী সিলেট ডেস্ক ::: এফআর টাওয়ারের ভবনের নকশাতেই অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি বলে মনে করছে প্রকৌশলীদের সংগঠন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটশন, বাংলাদেশ (আইইবি)। বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনা তদন্ত করে তারা এমন মন্তব্য করেন।

পর্যবেক্ষণে করে তারা বলেন, পাশাপাশি ভবনের বিভিন্ন ফ্লোর ব্যবহারকারীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো ভেতরের সাজসজ্জা করার কারণেই সেখানে আগুনে এত সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবনটির নকশা প্রণয়নে অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করা হয় নাই বলে প্রতীয়মান হয়। ভবনে যে জরুরী বহির্গমন সিঁড়িটি আছে সেটার অবস্থান সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ একটি স্থানে। এই সিঁড়িটি মূল সাধারণ সিঁড়ির সমান্তরাল পাশাপাশি অবস্থান। ফলে আগুনে সৃষ্ট ধোঁয়ায় যখন সিঁড়িঘর ও করিডোর পূর্ণ তখন জরুরি বহির্গমন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।এই ধরনের একটি সিঁড়ি থাকা না থাকা একই কথা।

এছাড়া বিভিন্ন ফ্লোরে এই সিঁড়ির প্রবেশ মুখের জায়গায় কোথাও নামাজের স্থান, কোথাও ‘বড় সাহেবের’ খাবারের স্থানে উঠেছিল তা আবার কোথাও ছিল তালাবন্ধ। ওই সিঁড়ি ধোঁয়ামুক্ত রাখারও কোনো ব্যবস্থা ছিল না, উপরন্তু বিভিন্ন জায়গায় সিঁড়ি ঘরের দেওয়াল ভেঙে কেবল লাইন করায় তা আরও অনিরাপদ হয়ে পড়েছিল বলে আইইবির তদন্তে উঠে এসেছে।

এত ত্রুটির পরেও কেউ এই জরুরি বহির্গমন পথ ব্যবহার করতে পারলে তার নিচে নেমে আসতে পারতেন বলে মনে করছেন এই প্রকৌশলীরা। কিন্তু ভবনে যে একটি জরুরি বহির্গমনের সিঁড়ি রয়েছে সেটা অনেকেরই অজানা ছিল। এটা অনেকেই হয়ত জানত না। ঘরের পাশের দরজা দিয়ে নিচে নামা যায় এটা যে কোনো জরুরি বহির্গমনের পথ নির্দেশনা দিয়ে বোঝানো ছিল না।

প্রসঙ্গত, ২৮ ফেব্রুয়ারি বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের ২৩তলা এফআর টাওয়ারে আগুনে ২৬ জনের মৃত্যু এবং অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন। ২০০৫ সালে এই ভবন নির্মাণ করেছিল রূপায়ন গ্রুপ, ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে সেখানে ২৩ তলা করা হয়েছিল বলে রাজউক জানিয়েছে।

এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এরই মধ্যে ওই ভবনের দুই মালিক বিএনপি নেতা তাসভীর উল ইসলাম ও প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মামলায় অপর আসামি করা হয়েছে রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলীকে।

অগ্নিকাণ্ডের পরপরই ঘটনা তদন্তে আইইবি তাদের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী নুরুল হুদাকে আহ্বায়ক ও সহকারী সাধারণ সম্পাদক কাজী খায়রুল বাশারকে সদস্য সচিব করে নয় সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-আইইবির সদস্য প্রকৌশলী মো. হামিদুল হক, অধ্যাপক মো. আব্দুর রশীদ, মো. হাবিবুর রহমান, অধ্যাপক মুনাজ আহমেদ নূর, ইয়াসির আরাফাত, ইয়াসির আরাফাত খান ও মাহমুদ আখতার শরিফ।

তদন্ত দলটি ১ এপ্রিল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এসে প্রতিবেদন তৈরি করে। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত, আগুন ছড়িয়ে পড়ার নানা কারণ ব্যাখ্যার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি সুপারিশ করে তার দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন আইইবির প্রকৌশলীরা।

এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডকে অশনি সংকেত হিসেবে বর্ণনা করে তারা বলেছেন, ঢাকা বা দেশের অন্যান্য শহরে হয়ত এ রকম শত শত ভবন রয়েছে। প্রতিটি ভবনের অগ্নি ঝুঁকি মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন এফআর টাওয়ারে শুধু অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ছিল তা নয়, ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল নকশা প্রণয়নে ও ভবন ব্যবহারে।

এফআর টাওয়ারের নির্মাণ ত্রুটি নিয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই ভবনের দুটি তলার মধ্যবর্তী অগ্নি সুরক্ষার জন্য যে উচ্চতার অগ্নি নিরোধক ছিল, তা ছিল ‘অপ্রতুল’। সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল গ্লাস দেওয়াল, যা সহজে ভঙ্গুর ও অগ্নি নিরোধক নয়। তাছাড়া ভবনের দুই পাশে অন্য ভবনের দূরত্ব ছিল দুই ফুটেরও কম।

ভবনের প্রতিটি তলায় ব্যবহারকারী বা ভবন মালিক ইচ্ছেমতো ডিজাইনের পরিবর্তন করেছেন জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, রান্না ঘর, টয়লেট সেপারেশন দেওয়াল এক এক তলায় এক এক রকম। যেমন, নবম তলায় যেখানে টয়লেট ও রান্না ঘর অষ্টম তলায় সেখানে অফিস রুম। ফলে অষ্টম তলার সিলিংয়ের উপর পিভিসি পাইপ গলে উপর তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

এফআর টাওয়ারের অষ্টম তলায় উত্তর-পূর্ব কোণে রান্নাঘর ও টাওয়ারের মধ্যবর্তী রুমটিকে আগুনের উৎপত্তিস্থল বলে মনে করছেন আইইবির প্রকৌশলীরা। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছোট এই রুমটিতে ছিল এয়ার কন্ডিশনার, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট তার, চেয়ার টেবিল ও কাপড় তৈরির সুতো। পাশের কিচেনে ছিল গ্যাস বার্নার। সুতরাং গ্যাসের লিকেজ, বৈদ্যুতিক তার বা এয়ার কন্ডিশনার থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।

আইইবি বলছে, ভবনের প্রায় প্রতিটি তলায় ন্যাচারাল ভেন্টিলেশনের যথেষ্ট অভাব ছিল। ভবনে কোনো অগ্নি নিরোধক দেয়াল ছিল না। ফলে উৎস যেখানেই হোক তা সম্পূর্ণ তলাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল। অতি স্বল্প সময়ে পুরো অষ্টম তলা ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়, যা সবাইকে জরুরি বহির্গমন করতে বাধ্য করে। তবে যাওয়ার সময় সম্ভবত অষ্টম তলায় অফিসের প্রবেশ দরজা বন্ধ না করেই সবাই বেরিয়ে যায়। ফলে সামনের সিঁড়ি ঘর হয়ে যায় ধোঁয়া বেরোনোর একমাত্র পথ, যা উপর তলার সবার বের হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধতা তৈরি করে। এমনকি নবম ও দশম তলার মানুষজনও সিঁড়ি ঘর দিয়ে নামতে পারে নাই। এক ঘণ্টার চেষ্টায় দশম তলার টয়লেটের গ্লাস ভেঙে পাশের ভবনের গ্রিল কেটে ৩০ জনের মতো বেরোতে পারে। ২৬ জনের মধ্যে অনেকের মৃত্যু হয়েছে বিষাক্ত ধোঁয়া ও অক্সিজেনের অভাবে।

ভবনে অগ্নি নিরোধক ব্যবস্থা নিয়ে তদন্তকারী দলটি বলেছে, এ ভবনে প্রয়োজনীয় পানি ও পানি উত্তোলনের জন্য প্রয়োজনীয় ফায়ার র‌্যাম্প ছিল না। আগুন নেভানোর জন্য হোজ রিল বাক্স মূল সিঁড়ির পাশে থাকলেও তা ব্যবহার করা যায়নি। কোনো কোনো ফ্লোরে হোজ রিল বাক্সে রিলই ছিল না, তা ব্যবহার হত শেলফ হিসেবে।

তাদের মতে, ভবনে কার্যত কোনো অগ্নি নিরোধক ব্যবস্থাই ছিল না। এ রকম ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ১৫ টি সুপারিশও করা হয়েছে প্রতিবেদনে, যেখানে ভবনের নকশা প্রণয়নে অগ্নি ঝুঁকি কমানোর বিষয়টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে।

তাদের অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের খসড়াটি দ্রুত গেজেট আকারে প্রকাশ করা, সরকারি কমিটি করে ভবনের নকশাকারী ও রিভিউয়ারের যোগ্যতা নির্ধারণ, ইমারত নির্মাণ বিধিমালার আলোকে বহুতল ভবনে সিঁড়ি ও অগ্নি নিরাপত্তার কার্যকরী ব্যবস্থা প্রণয়ন, ভবন থেকে ৫০ ফুট দূরে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা, প্রতি ছয় মাস অন্তর প্রতিটি সুউচ্চ ভবনে অগ্নি নিরাপত্তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, রাজউক-সিটি করপোরেশনসহ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।

সংবাদটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন
0Shares
সংবাদটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন

সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম