সিলেট ৬ই জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ২৩শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | ১৭ই জিলকদ, ১৪৪৪ হিজরি
প্রকাশিত: ৭:০৪ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১২, ২০১৮
সুরমা নদীর দক্ষিণ তীর ঘেষে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা জনপদের অবস্থান। শহরের কাছের জনপদ হওয়ায় ১৯৭১ সালের তৎকালীন সিলেটের বিভিন্ন জেলা ও থানার গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও সদরের অনেক ইউনিয়ন পরিষদের অবস্থান ছিল এখানে। সড়ক ও রেলপথে মূল শহরে প্রবেশ করতে হয় দক্ষিণ সুরমা দিয়ে। ফলে অবস্থানগত কারণে এ জনপদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ । মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই জনপদের মানুষ গৌরবময় ভূমিকা রেখেছেন। একাত্তর এর ডিসেম্বর মাস। আজ ১৩ ডিসেম্বর, আজকের এই দিনে দক্ষিণ সুরমার সম্মুখ যুদ্ধ ও পাকহানাদার মুক্ত হয় কদমতলীসহ গোটা দক্ষিণ সুরমা।
ফিরে দেখা সেই দিনগুলি : সারা দেশের মতো সিলেটের মুক্তিযোদ্ধারাও সম্মুখ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই সময় দক্ষিণ সুরমার কদমতলীস্থ পুরাতন বাস স্ট্যান্ড এলাকার বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা চত্বরের বিপরীতে ছিল পাক হানাদার বাহিনীর সেনাদের ক্যাম্প। মেজর সরফরাজ, মেজর বশারত, হাবিলদার মোস্তাকের নেতৃত্বে ২০০-২৫০ জন হানাদার বাহিনী সেখানে অবস্থান করত। তাদের সাথে যোগ হয় ১৫-২০ জন রাজাকার। যাদের সকলের বসত ছিল দক্ষিণ সুরমা এলাকায়। বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা চত্বরে একদিকে সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়ক, অপরদিকে সিলেট-জকিগঞ্জ ও সুতারকান্দি সড়ক। এ দু’টি সড়কের মধ্যবর্তী স্থানে ছিল বিরাট বটগাছ। বটগাছের নীচেই ছিল হানাদার বাহিনীর চেকপোষ্ট। চেকপোষ্টে নিয়মিত বাস যাত্রীদের নামিয়ে হয়রানী করা হত। দখলকার বাহিনীর লোকেরা যাত্রীদের অনেককে ধরে নিয়ে যেত সুরমা নদীর তীরে। তারপর গুলি করে হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দিত সুরমার জলে। কেউ তাদের না চেনায় এসব হতভাগাদের নাম শহীদদের তালিকায়ও ঠাঁই পায়নি। সিলেটের কদমতলী বাস স্ট্যান্ড মসজিদের অজুখানার উত্তরদিকে গর্তে গুলি করে প্রায়ই নিরপরাদ মানুষদের হত্যা করত। প্রায় প্রতিদিনই তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে চোখ বাঁধা অবস্থায় ভ্যানে করে লোকজনকে ধরে নিয়ে আসত ক্যাম্পে। তারপরে এসব বন্দীদের নিয়ে শিববাড়ী লালমাটি এলাকার রেললাইনের পশ্চিম দিকে গুলি করে হত্যা করে মাটি চাপা দিত। এলাকাটি বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। ৭১’ এর ৮ ও ৯ ডিসেম্বর ডুবরি হাওর বর্তমান উপশহর, হাদারপাড়া, তেররতন এলাকায় হেলিকপ্টার যোগে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী অবস্থান নেয় এবং আমি আমার এলাকার আলতু মিয়া পীরকে নিয়ে আমার সাথে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ভারতের দেরাদুনের মহল্লাল সম ও সদর উদ্দীন চৌধুরী, মকসুদ ইবনে আজিজ লামা, ছানাওর আলী, আব্দুশ শহিদ বাবুল, বাবুদন মিয়া, সুলেমান এদের সাথে হযরত বুরহান উদ্দিন (রহ.) মাজারে সাক্ষাৎ করি। পরবর্তীতে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়। আমরা যত্রভঙ্গ হয়ে যাই এবং আমি আবার দক্ষিণ সুরমায় হামিদ মিয়ার বাড়িতে অবস্থান করি। এখানে আমার সাথে সংযুক্ত হয় আমার গ্রামের চাচাত ভাই আঃ মুক্তাদির আব্দুল মতিন (খোজারখলা), আফরাইম আলী (মোল¬ারগাঁও), মনির উদ্দিন (মোল¬ারগাঁও), ছইল মিয়া (খালেরমুখ), আনোয়ার হোসেন গামা (ছড়ারপার), জলাল উদ্দিন ও শাসস উদ্দিন (মাছিমপুর), বেলাওয়াত হোসেন খাঁন (হবিগঞ্জ) আরো ২/৩ জনের নাম মনে পড়ছে না। ঐদিনই পরিকল্পনা হয় রেলস্টেশনে অবস্থানরত মিত্র বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করে কদমতলী বাসস্ট্যান্ডে (পুরাতন) আর্মি ক্যাম্পে আক্রমন করা দরকার। সেই অনুযায়ী মিত্র বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করে আক্রমন করার পরিকল্পনা করি। ১৩ ডিসেম্বর আমাদের অবস্থান মরহুম হামিদ মিয়ার বাড়িতেই। ১২ ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক ১১ টার দিকে খবর পাই ৫ জন পাকিস্তানী সেনা আলমপুর শিল্পনগরীর দিক হতে হেঁটে কদমতলী ক্যাম্পের দিকে আসছে। তাৎক্ষণিক আমরা বর্তমান পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের নিকট ডিফেন্স গ্রহণ করি এবং তারা আসার সাথে সাথেই গুলিবর্ষণ করলে ৩ জন হাওড় দিয়ে দৌড়াতে থাকে এবং নদীর পাড়ে চলে যায়। দুইজন কদমতলীস্থ খলকু মিয়ার বাড়িতে অবসস্থান নেয়। পরবর্তীতে সুকৌশলে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করাই। তাদের ব্যবহৃত চায়নিজ রাইফেল আয়ত্বে আনি এবং তাদের দুইজনকে মরহুম হামিদ মিয়ার বাড়ীতে ধান রাখার গুদামে বন্দী করে রাখি। ১৩ ডিসেম্বর ভোর ৬ ঘটিকায় মিত্র বাহিনীর মেনিখলাস্থ রাস্তায় আসলে আমরা তাদের সাথে যোগ দেই। তাদেরকে নিয়ে বর্তমান আনন্দ বিপনী মার্কেটের সামনে ব্যাঙ্কার সৃষ্টি করে পজিশন নিয়ে ক্যাম্পের দিকে গুলিবর্ষণ করি। পাক সেনারা ক্যাম্প হতে ক্যাম্পের পিছনে গোরস্থান ও ইট ভাটায় আশ্রয় নেয়। অনেক গোলাগুলির পর প্রায় বিকাল ৩ টার দিকে ২১ জন সারেন্ডার করে। এই সময় নদীর উত্তরপাড় হতে একটা মর্টার আমাদের ব্যাঙ্কারের উপর পড়ে। ব্যাঙ্কারে অবস্থানরত সুবেদার রানা ও তার সাথে মিত্র বাহিনীর দুইজন ঘটনাস্থলে মারা যান। পরবর্তীতে আমরা ২১ জন পাকসেনা ও হামিদ মিয়ার বাড়ীতে বন্দী থাকা দুইজন এই ২৩ জনকে শহীদ রানাসহ মিত্র বাহিনীর আরো দুইজন শহীদ এদেরকে মিত্র বাহিনীর অবস্থিত ক্যাম্প রেলস্টেশনে নিয়ে যাই। আমরা ও আমাদের গ্রামের যুবক মজম্মিল বক্ত, মকবুল হোসেন, কবির আহমদ ও ইছহাক মিয়া সহ আরো অন্যান্যরা। ঐ দিন রাতে আমরা হামিদ মিয়ার বাড়িতে অবস্থান করি। ১৪ ডিসেম্বর মঈন উদ্দিন মিয়ার বাড়ী হতে আত্মগোপন অবস্থায় আরেকজন পাকসেনাকে আটক করি। তাকেও রেলস্টেশনে পৌছে দেই। এরপর মোগলাবাজার হতে আসা একটি আর্মি ভ্যান গুলি করে ড্রাইভারকে হত্যা করি ঝালোপাড়া মসজিদের সামনে এরপর ১৪ ডিসেম্বর বিকালে আমার নেতৃত্বে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে মোারগাঁও কলাপাড়া ও জিন্দাবাজারে বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করি।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক
সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক,
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ,
কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল ঢাকা।
প্রকাশক ও সম্পাদক : মোঃ তাজুল ইসলাম,
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : নাঈমুর রহমান নাঈম
উপদেষ্টা : উস্তার আলী
সম্পাদক কর্তৃক বার্তা অফসেট প্রেস, লিয়াকত ভবন, জল্লারপাড় রোড, জিন্দাবাজার, সিলেট থেকে মুদ্রিত ও প্রধান কার্যালয় : সামসুদ্দিন মার্কেট,(২য় তলা) পুরাতন পুলের মুখ ভার্থখলা,দক্ষিণ সুরমা সিলেট থেকে প্রকাশিত।
ফোন : ০২৯৯৬৬৩২৩০১
মোবাইল : ০১৭১১-৩৯৯৬৬৬, ০১৭৩৩-৫৭৫৯২০ (সম্পাদক ও প্রকাশক)
ই-মেইল : sonalysylhet2016@gmail.com
Web : www.sonalysylhet.net
Design and developed by ওয়েব হোম বিডি