সাউথ এশিয়ান হেরিটেজ মাসের ভাবনা

প্রকাশিত: ৫:০০ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৬, ২০২২

সাউথ এশিয়ান হেরিটেজ মাসের ভাবনা

লেখক: রাজু মিয়া
সহ সভাপতি, বিএএমই নেটওয়ার্ক


সোমবার ১৮ জুলাই ২০২২ থেকে ১৭ আগস্ট ২০২২ বুধবার পর্যন্ত ‘সাউথ এশিয়ান এরিটেজ মান্থ’ পালিত হচ্ছে। প্রায় ৭০ বছর আগে আমার বাবা মায়ের পরিবার মানে আমার দাদা দাদী/নানা নানী ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে সর্বপ্রথম যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন। তাদের কাছে সেসব দিনের অনেক রঙিন গল্প শুনেছি- কিভাবে তারা এশিয়ান উপমহাদেশের একটি দেশ বাংলাদেশ থেকে এসে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিলেন। কিন্তু বাইরের একটা দেশ থেকে এসে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা খুব সহজ ছিল না।

 

১৯৬০ দশকের দিকে আমার দাদা দাদীরা শেষপর্যন্ত যখন যুক্তরাজ্যে বসতি স্থাপন করেন, আমার বাবা মা তখন বার্মিংহামে অভ্যন্তরীণ শহরে বসবাস করতেন। এখানে জীবন যাপন অনেক কঠিন ছিল, শ্রমঘণ্টা অনুযায়ী পরিবারের পুরুষদের দীর্ঘ সময় বাইরে কাজ করতে হতো। দক্ষিণ এশীয় অনেক পরিবারের মতন আমার বাবা মাও এমন একটি এলাকায় বেড়ে উঠেছেন- যেটা একচেটিয়াভাবে বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকা ছিল এবং এখানে অবাঙালিদের সাথে তেমন মেলামেশা ছিল না বলে তাদের সাথে সহজ কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠতো না।

 

ফলস্বরূপ আমাদের জনগোষ্ঠীর জন্য যুক্তরাজ্যের দেয়া সুযোগ সুবিধা ভোগ করা কঠিন ছিল। ফলে অবাঙালিদের সাথে মেলামেশা করাও আমাদের জন্যে জরুরী ছিল।

 

উল্লেখ্য যে, সে যুগে কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশগুলো থেকে একটি বিশাল অংশ যারা এখানে স্থানান্তরিত হতো তাদের সবাইকে বাসস্থান বেছে নেয়া এবং কাজ খুঁজে নেয়ার ক্ষেত্রে প্রায়ই নানান সমস্যায় পড়তে হতো। অধিকাংশই ভালো ইংলিশ বলতে পারতেন না বলে এটা আরো জটিলতা সৃষ্টি করত।

 

সৌভাগ্যবশত আমার দাদা দাদীরা কিছু সম্পত্তি ক্রয় করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা আমার বাবা মায়ের জন্যে ভালো স্কুল এবং কলেজে পড়া সহজ করে দিয়েছিল। আমার বাবা মায়ের অনেক বন্ধুই তা করতে পারেন নি।

 

১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে আমার বাবা মায়ের দেশ একটি বড় পরিবর্তন দেখেছিল। আজকের বাংলাদেশ তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে নিজেদের আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল।

 

প্রতিটা বাংলাদেশির জন্যে এই সময়টা বেশ কঠিন ছিল- কারণ, মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে একদম স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের পরিবার থেকে তখন বহু হতাহতের খবর আসতো। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে আমার পরিবারও বাইরে ছিল না।

 

প্রায় একই সময়ে, আমার বাবা মা বার্মিংহাম থেকে স্কটল্যান্ড তাদের আত্মীয় স্বজনের পাশাপাশি থাকতে চলে যান, ফলে আমাদের ভাই বোনরা আরো উন্নত একটি জীবন পাই।

 

আমার বাবা মা আমাদের জন্যে যে ত্যাগ স্বীকার করছেন তার জন্যে আমি কৃতজ্ঞ এবং গর্বিত। কারণ তারা প্রথমে যে অঞ্চলে বসবাস করতেন সেখানে বাঙালি অধ্যুষিত পরিবেশ ছেড়ে সম্পূর্ণ একটি অচেনা শহরে নিজেদের স্থানান্তরিত করা বেশ কঠিন ছিল। ব্রিটিশ এশিয়ানদের প্রথম প্রজন্ম হয়ে এসে তারা যে বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন তা সত্যিই আমাকে ব্যথিত করে।

 

ইউকেতে শিকড় স্থাপনে আমার পরিবার যে কস্টের সম্মুখীন হয়েছিল আমি তার প্রশংসা করি। যদিও সাদা জাতি স্কটিশদের শহরে বেড়ে উঠার যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি তাদের তা হতে হয় নী।

 

ছোট বেলায় আমাকে অনেক কিছুর সাথে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হতো, যেমন প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সাথে সাথে আরবী ক্লাসে যাওয়া, এমনকি স্থানীয় মসজিদে যাওয়াসহ সপ্তাহান্তে বাংলা ভাষা শিক্ষা স্কুলেও যেতে হতো।

 

আমি এমন একটা প্রজন্মে বেড়ে উঠেছি যারা আমাকে প্রশ্ন করে- আমি কোথা থেকে এসেছি? আমার আসল পরিচয় কি?

 

আমার চেহারা দেখতে এমন যে, না আমি পুরোপুরি দক্ষিণ এশিয়ান, না আমি ব্রিটিশ চেহারার। সে সময় একজন শিশু হিসেবে এটা আমার কাছে বেশ কঠিন একটি বিষয় ছিল দুই জাতিতে ভারসাম্য বজায় রেখে চলা।

 

নিজেকে স্বাচ্ছন্দের একটা জায়গায় আনার জন্যে আমার নিজেকে খুব তাড়াতাড়ি পরিপক্ক হতে হয়েছিল, যাতে আমি আমার পরিচিতি তৈরি করে একটা সুন্দর জীবন গড়তে পারি।

 

পরিবারের প্রথম হিসেবে আমি স্বনামধন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য পেয়েছিলাম। আজ আমি অনেক বাঙালি পুরুষ মহিলাকে দেখি যারা আমার মতন সেই সুযোগ পায়নি। ফলে দুঃখজনকভাবে এখনো তারা গুরুত্বপূর্ণ কোনো পেশা বাছাই করে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না।

 

যাই হোক, আমি যা অর্জন করেছি তার জন্যে আমি গর্ববোধ করি এবং আমার পূর্বসূরি/ উত্তরসূরীকে গর্বিত করতে চাই এজন্যে যে, এত কঠিন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আমরা ভালো সুযোগসুবিধা ও ভালো চাকরি পেতে পারি।

 

ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের একটি বড় অংশ স্বাস্থ্য সেবা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্যের সম্মুখীন। অনেকে ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল জনিত বিভিন্ন জটিল সমস্যায় ভোগছেন।

 

দক্ষিণ এশিয়ান অন্যান্য গুষ্টিগুলো এই দিকগুলোতে যথেষ্ট উন্নতি করতে সক্ষম হলেও সেই তুলনায় ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের উন্নতি হচ্ছে খুব ধীর গতিতে।

 

১৯৬০ এর দশকে কমনওয়েলথে আসা নতুন সদস্যদের মধ্যে বাংলাদেশ হচ্ছে সবথেকে কনিষ্ট দেশ, যা স্বাস্থ্য ও সামাজিক বৈষম্যের ধীর গতিতে উন্নয়নের একটি বিশেষ কারণ।

 

পূর্ব প্রজন্মকে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্ম সুন্দরভাবে তাদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে যেখানে তারা জন্মগ্রহণ করেছে সে সমাজ সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে।

 

বাংলাদেশ একটি সুন্দর প্রাণবন্ত দেশ। উন্নয়নের হার এবং অর্থনীতির সূচকের বৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে অনুপ্রেরণার বিরাট এক উৎস।

 

বাংলাদেশ এমন একটি উন্নয়নশীল দেশ যে দ্রুত দারিদ্রের হার হ্রাস করছে, নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে তাদের বিনামূল্যে পড়াশোনা করে ক্যারিয়ার গড়তে যোগ্য করে দিচ্ছে।

 

বিশ্বব্যাংক বলছে, এসব উন্নতির কারণে বাংলাদেশ আর নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ হবে না এবং জিডিপির অবিশ্বাস্য প্রবৃদ্ধির এবং জীবনমানের উন্নতির কারণে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের অবস্থানে চলে গেছে।

 

আজ আমি এখনো বিভ্রান্ত হই, যখন মানুষ আমাকে প্রশ্ন করে যে, জাতিগত দিক থেকে আমি কোথা হতে এসেছি? আমি কি স্কটিশ? আমি কি ব্রিটিশ? আমি কি বাংলাদেশী? নাকী আমি একের ভেতর সব!

 

এর উত্তরে আমি যা বলতে পারি, আমি আমার বাংলাদেশী ঐতিহ্যের ধারক বাহক হয়ে গর্বিত এবং আমি যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছি তার জন্যেও গর্বিত।

 

এই দুয়ে মিলে আমাকে বর্তমানে একজন সফল মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে।

সংবাদটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন
0Shares
সংবাদটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন

সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম