সিলেট ২৩শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ | ১লা রমজান, ১৪৪৪ হিজরি
প্রকাশিত: ৯:২৬ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৫, ২০২০
এন আর নাঈম
নগরের কালিঘাট এলাকায় কিছুতেই থামছে না ভারতীয় শিলং তীর ও ঝান্ডুমান্ডু নামক জুয়ার আসর। দিনে টোকনের মাধ্যমে চলে তীর আর রাতে বসে ঝান্ডুমান্ডু জুয়ার আসর। এই জুয়ার বোর্ড বসিয়ে অনেকেই এখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।
বোর্ড পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্টরা রাতারাতি বনে গেছেন কোটিপতি। এটা অনেকটা আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মতোই। এখানে রাজার হালে খেলতে আসা অনেকেই ফকির বেশে বেরিয়ে যান। সর্বস্ব খুইয়ে অবশেষে শূন্য হাতে বাড়ি ফেরেন। খোয়ানো অর্থ ফিরে পাবার আশায় পরদিন আবারও ফেরেন জুয়ার আড্ডায়। কিন্তু খেলতে হলেতো টাকা লাগবে, টাকা আসবে কোথাত্থেকে। তাই কোনো উপায়ন্তর না দেখে বেছে নেন ছিনতাইর মত জঘন্য পথ। নগরে গত কয়েক দিনে ছিনতাই হওয়া ঘটনার সাথে জড়িত এসব জুয়াড়িদের অবস্থান কালিঘাটস্থ পেঁয়াজপট্টির অলি-গলিতে। শুধুমাত্র জুয়ার টাকা জোগাড়ে তারা জঘন্যতম এই পথ বেছে নিয়েছে। থানা পুলিশ মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে দু’একজনকে আটক করলেও আদালতের মাধ্যমে নামমাত্র জরিমানা দিয়ে বেরিয়ে এসে আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠে তারা।
কালিঘাটের পেঁয়াজপট্টির জুয়ার বোর্ডের অবস্থান নিশ্চিত হতে অনুসন্ধানে নামলে বেরিয়ে আসে অনেক অজানা তথ্য। খালি চোখে গোটা পেঁয়াজপট্টিতে বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখা গেলেও অদেখায় রয়েছে অনেক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের স্তুপ। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ভারতীয় শিলং তীর ও ঝান্ডুমান্ডু নামক জুয়ার আসর। পেঁয়াজপট্টির বাণিজ্যিক ভবনের গেইট দিয়ে ভিতরের শেষ মাথায় গিয়ে হাতের ডান দিকে সুরমা নদীর তীর ঘেঁসে টিন শেডের ঘরেই এই আসরের অবস্থান। আসরের সামনের অংশটাতে দুই/ তিনটি বেঞ্চ দিয়ে সাজিয়ে চায়ের দোকান হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। দূর থেকে দেখলে অনায়াসে চায়ের দোকান ছাড়া অন্য কিছু বুঝার উপায় নেই। কিন্তু ভেতরে ঢুকলে চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা। সব বয়সি লোকের ব্যাপক সমাগম রয়েছে সেখানে। খুব বেশিই ব্যবসা করছে এই চা দোকানী? বাহির থেকে দেখলে ঠিক এমনটিই মনে হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে যারা ভিড় করছে তারা কেউই চা খেতে আসেনি। এসেছে শিলং তীরে নিজেদের পছন্দের নাম্বারটি লেখাতে। বিনিময়ে রেখে যাচ্ছেন হাজার হাজার টাকা। একটিমাত্র নাম্বারের উপর ভরসা করে সবগুলো টাকা এখানে রেখে যাচ্ছে জুয়াড়িরা। কেউ কেউ আবার ইন্টারনেট ঘেটে আজকের সফল নাম্বারটির ব্যাপারে বেশ নিশ্চিত হয়েই টাকা ছাড়ছে। বোর্ড কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র দুই হাতে টাকা গুনছেন আর কাগজের টোকনে নাম্বার লিখে তা ধরিয়ে দিচ্ছেন গ্রাহকদের হাতে। কী আজগুবি এক ব্যাপার ঘটে প্রতিনিয়ত। এখানে সবার হাতে যেনো একেকটি আলাদিনের চেরাগ। অপেক্ষায় থাকতে হলো শেষ দৃশ্যটা দেখার জন্য। বিকেল সোয়া ৪টা নাগাদ শোনা গেল খেলায় ড্র হয়ে গেছে। এবার নাম্বার মেলানোর পালা। অনেকটা জোরেশোরেই নাম্বার কল করলেন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। তখন মাথায় হাত দিয়ে আফসোস করতে শোনা গেলো অনেককেই। রিকশা চালক থেকে শুরু করে এখানকার অনেক ব্যবসায়ীরাও টাকা রেখেছেন বোর্ডে। দশ টাকার বিনিময়ে পেয়ে যাবেন ৭শত টাকা। আর একশ’ টাকার বিনিময়ে ৭ হাজার টাকা। কিন্তু কিছুই জুটেনি কপালে। আজকের রোজগারসহ গত এক সপ্তাহের রোজগারও যেনো হারিয়ে গেছে একটি নাম্বারের কারণে। নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে তাদের। এটা ভাবতেই মাথায় হাত রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
দিনের গণ্ডি পেরিয়ে এবার রাত। শুরু হবে নতুন আরেক আসর। এই আসরের নাম ঝান্ডুমান্ডু। এবার দেখার পালা সেই আসরের আশেকান কারা কারা। নাহ! অবস্থা প্রায়ই দিনের মতো। এখনও সব বয়সিদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। যারা শিলংয়ে বিশ্বাসী নয় কেবল তাদের জন্যই বোধ হয় এই আসর। আসরতো দেখা হয়ে গেলো এখন খুঁজতে হবে কারা রয়েছে এই আসরগুলোর পেছনে। আবারও অনুসন্ধান। বেরিয়ে এলো অনেক নতুন তথ্য।
ভারতীয় তীর শিলং ও ঝান্ডু-মান্ডু জুয়ার আসরের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ছড়ারপার-কালিঘাটের স্থানীয় ও বহিরাগত মিলে প্রায় ৩৫-৪০ জন যুবক। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন- মিজান, দিপু, জামাল, ঘাটম্যান লোকমান, শরিফসহ আরও অনেকে। এখানে প্রতিদিন দুপুর ৩টা থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত জুয়া খেলা চলে। দিনের বেলা শিলং তীর, রাতে বসে ঝান্ডু-মান্ডু ও তিন তাস নামক জুয়ার আসর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘ভাই এখানে আমরা বড় বিপদে আছি। আপনারা সাংবাদিকরা এই জুয়া খেলার বিরুদ্ধে কিছু লিখুন। আপনাদের লেখার কারণে হয়তো প্রশাসনের টনক নড়বে। আমরাতো নিরীহ মানুষ, কিছু বলতেও পারছি না, আবার সহ্যও করতে পারছি না। কিছু বলতে গেলে বিভিন্ন ধরনের হুমকি ধমকি আসে। এখানে খেলা শুরু হওয়ার পর থেকেই চুরির মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে। এইতো দু’দিন আগে আমার একটা তেলের টিন ও একটা সাবানের কার্টন মুহ‚র্তের মধ্যে আমার সামন থেকে চুরি হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা এসব জুয়ার বোর্ডের মালিকদের কাছ থেকে অবৈধভাবে সুবিধা নিয়ে এদেরকে সুযোগ করে দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে তীর খেলা বন্ধে অভিযান চললেও কোনো সুফল মিলছে না।’
সাম্প্রতিক সময়ে কালিঘাট এলাকায় শিলং তীর এবং ঝান্ডুু-মান্ডু খেলার উৎপাত দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন স্থানীয় সচেতন মহল।
ক্ষোভের সাথে তারা জানান, এ এলাকায় প্রকাশ্যেই শিলং তীর খেলার টোকেন বিক্রি হওয়ায় নারী-পুরুষ দল বেঁধে লাভের আশায় এই খেলায় প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে। লাভতো দূরের কথা, এসব খেলে অনেকেই নিঃস্ব হচ্ছে। আর ভারতীয় এ ভাগ্যের খেলায় স্কুল-কলেজের ছাত্র, দিনমজুর, রিকশাচালক, যানবাহন চালক-শ্রমিকসহ বেকার যুবকরা বেশিই অংশ নিচ্ছে। প্রতিদিন বিকাল সোয়া ৪টায় ও সাড়ে ৫টায় এবং রাত সাড়ে ১০টায় এ লটারির ড্র অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। খেলার ফলাফল দেওয়া হয় অনলাইনে। ভারতের শিলং থেকে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জুয়ার আসরটি পরিচালনা করা হয়। আর এ ওয়েব সাইটের মাধ্যমে অ্যান্ড্রুয়েড মোবাইল ফোনেও ফলাফল জানা যাচ্ছে। আর এসব জুয়ার নেতৃত্বে রয়েছে এলাকার প্রভাবশালী কিছু লোকজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, তারা নিজ চোখে দেখেছেন টহলরত ডিউটি পুলিশ ও প্রেস লিখা বিভিন্ন পত্রিকার কিছু হলুদ সাংবাদিক জুয়ার বোর্ডে টাকা নিতে প্রতিনিয়তই আসেন।
ঐতিহ্যবাহী কালিঘাটের মত স্থান থেকে অপরাধমূলক এসব জুয়ার আসর স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন কালিঘাটের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় সচেতন মহল।
পুলিশ সূত্রমতে জানা যায়, গত কয়েক মাসে সিলেটে অন্তত শতাধিক জুয়ার আসর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আর এই অভিযানে সবচেয়ে বেশি প্রশংসার দাবিদার সিলেট মহানগর পুলিশ। কিন্তু কিছু অসাধু পুলিশের মাঠপর্যায়ের সদস্যদের কারণে তা স্থায়ীভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না। তাদের প্রকাশ্য মদদে এসকল জুয়া খেলা ফের ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ছে নগরের সর্বত্র।
গত ১৬ জুলাই কালিঘাটে জুয়া খেলার বিষয়টি সর্ম্পকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির আইসি এসআই আকবর হোসেনকে অবগত করেন আমাদের এ প্রতিবেদক। তখন তিনি কোনোরূপ কর্ণপাত করেননি বা আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেননি। পরবর্তীতে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানালে তাৎক্ষণিক অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়।
উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ এর নেতৃত্বে নগরের কালিঘাট বাণিজ্যিক ভবনের পিছনে অভিযান চােিলয়ে ৫ জুয়াড়িকে আটক করা হয়। বাকি ৩০/৩৫জন জুয়াড়ী পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে বিভিন্নভাবে পালিয়ে যায়। সেই সময় কালিঘাটে অনেক ব্যবসায়ীকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেখা যায়। স্থানীয় অনেক ব্যবসায়ীরা পুলিশকে তাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ দিতেও দেখা যায়। কিন্তু বিধিবাম সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে ‘যেই লাউ-সেই কদু’, গত ১৬ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় যেখানে অভিযান পরিচালনা করা হয়। ১৭ তারিখ আবার সেখানেই আগের চেয়ে বড় পরিসরে জুয়ার আসর বসতে দেখা যায়। পুলিশ প্রশাসনের প্রতি মানুষের আস্থা একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। নতুন জুয়ার আসর বসা নিয়ে সেখানকার ব্যবসায়ীসহ স্থানীয়দের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছেন, অভিযান হওয়াতে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি ও কোতোয়ালী থানার বেশি লাভ হয়েছে। তাদের উৎকোচের পরিমাণ আগের চেয়ে আরও বেশি হয়েছে।
কারণ হিসেবে তারা বলেন, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি ও কোতোয়ালী থানাকে উৎকোচের মাধ্যমে ম্যানেজ করেই জুয়াড়িরা তাদের খেলা পরিচালনা করছে। আর তাই যদি না হয়, তাহলে আগের দিন যেখানে এতো ঢালাওভাবে অভিযান পরিচালনা করা হলো। সেখোনে পরেরদিন থেকে কিভাবে আরও বড় পরিসরে নিশ্চিন্তমনে জুয়াড়িরা তাদের খেলা পরিচালনা করছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ জানান, অভিযানের পর আবারও খেলা হচ্ছে সেটা জানতাম না, খোঁজ নিয়ে খুব শিগগরই অভিযান চালানো হবে।
সংবাদটি ভাল লাগলে শেয়ার করুনপ্রকাশক ও সম্পাদক : মোঃ তাজুল ইসলাম,
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : নাঈমুর রহমান নাঈম
উপদেষ্টা : উস্তার আলী
সম্পাদক কর্তৃক বার্তা অফসেট প্রেস, লিয়াকত ভবন, জল্লারপাড় রোড, জিন্দাবাজার, সিলেট থেকে মুদ্রিত ও প্রধান কার্যালয় : সামসুদ্দিন মার্কেট,(২য় তলা) পুরাতন পুলের মুখ ভার্থখলা,দক্ষিণ সুরমা সিলেট থেকে প্রকাশিত।
ফোন : ০২৯৯৬৬৩২৩০১
মোবাইল : ০১৭১১-৩৯৯৬৬৬, ০১৭৩৩-৫৭৫৯২০ (সম্পাদক ও প্রকাশক)
ই-মেইল : sonalysylhet2016@gmail.com
Web : www.sonalysylhet.net
Design and developed by ওয়েব হোম বিডি